নলছিটি উপজেলার ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান এই উপজেলার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের দক্ষিনে পশ্চিম দিকে অবস্থিত এই উপজেলাকে ঘিরে রয়েছে বরিশাল বিভাগ, ঢাকা বিভাগ এবং খুলনা বিভাগ, এখানে ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের অন্যান্য উপজেলার মতই। তবে কিছুটা বৈচিত্র খুজে পাওয়া যায়। এখানকার বেশীরভাগ মানুষ স্বনামধন্য বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। সুগন্ধা নদীর গতিপ্রকৃতি এবং সবুজের সমারোহ ঝালকাঠীর মানুষের আচার-আচারন, খাদ্যভ্যাস ভাষা ও সংস্কৃতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এছাড়া এখানকার মানুষ অধিক অতিথিপরায়ন বলে সারা বাংলাদেশে সুপরিচিত।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ঝালকাঠীতে প্রাচীনকালে নামিদামী জমিদারের অসিত্মত্ব এখানে বেশী। জমিদার বাড়ির উলেস্নখযোগ্য পর্যটন স্থানও রয়েছে এই ঝালকাঠী সদর উপজেলায়। এছাড়া সাস্কৃতিক অঙ্গনে ঝালকাঠীর অবদানও অনস্বীকার্য। বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাস ও কবি কামিনী রায়ের জন্ম এই সুপ্রাচীন ঝালকাঠী সদর উপজেলায়।
যাত্রা গানঃ
যাত্রা গানের ইতিহাসে ঝালকাঠির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পঞ্চাশের শতকেও পশ্চিম বাংলার তথ্য এ দেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মুখে উচ্চারিত হতো নট্ট কোম্পানীর যাত্রা গানের কথা। এ নট্ট কোম্পানী ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশার পাঁজিপুঁথিপাড়া গ্রামের বাবু শশীভূষণ নট্ট এবং তার ভাই হারান চন্দ্র নট্ট প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ট যাত্রা দল নট্ট কোম্পানী। তখন সামাজিক বেড়াজাল পেরিয়ে মহিলারা যাত্রা পালায় অংশ নিতে পারতেন না। সে কারণে মহিলা চরিত্রে ছেলেদের দিয়ে অভিনয় করানো হতো। শিল্পসম্মত অভিনয়, কাহিনী বিন্যাস ও বিবেকের গান বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ও সামাজিক |
পালাগানঃ
পালাগান লোক সংস্কৃতির আর একটি অন্যতম আকর্ষণ। পোনাবালিয়ার অপরুপ সুন্দরী আয়না বিবি পালাগান গেয়ে বরিশালসহ আশপাশের জেলাগুলোতে খ্যাতি অর্জন করেন। আয়না বিবির সৌন্দর্য ও কন্ঠ মাধুর্যে আকৃষ্ঠ হয়ে তাকে ভাষাণ পালাগানের সম্রাজ্ঞী উপাধী দিয়েছিলেন শিল্পানুরাগীরা। পরবর্তীকালে দুটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি পালাগানের সৃষ্টি হয়েছিল, গুনাই বিবির পালা ও আসমান সিং এর পালা। যার প্রচার সর্বজনবিদিত। |
গুনাই বিবিঃ
গুনাই বিবির পালা একটি সত্য ঘটনাশ্রয়ী। ব্রিটিশ শাসনামলে ঝালকাঠির বর্ধিষ্ণু ও সমৃদ্ধ নবগ্রাম এলাকায় গুনাই ও তোতার প্রেম পরিনয়ের কাহিনী রচিত হয়। গ্রাম্য কবিয়ালরা হাটে হাটে সুর করে এ কবিতা পড়ে শ্রোতাদের কাছে এ কবিতার বই বিক্রি করতেন। এ কাহিনী নিয়ে পর্যায়ক্রমে রচিত হয়েছে পালাগান, যাত্রাপালা ও লোকনাট্য। এ কাহিনীর সবগুলোই সংগীত প্রধান। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গোলাম মোস্তফা মাসুমের গুনাই বিবি, ডাঃ চারুচন্দ্র রায়ের আসল গুনাই বিবি ও তোতা মিয়া, এ,কে,এম, শহীদুল হকের গুনাই বিবি এবং ডঃ বিপ্লব বালার লোকনাট্য গুনাই বিবি। তবে প্রত্যক রচয়িতাই কাহিনীর নাটকীয় মুহুর্তগুলোর জন্য যে গান ব্যবহার করেছেন তা প্রায় সব একই ধরনের গান ।
গুনাই বিবির সংক্ষিপ্ত কাহিনীঃ
গ্রামের সম্ভ্রান্ত গাজী পরিবারের আদরের সুন্দরী মেয়ে গুনাই বিবি। পিতৃহীন গুনাই বিবি ছিল ভাই রফিকের আদরের নয়নমনি। অন্যদিকে লম্পট ও অসৎজমিদার দুলু মিয়ার ভাই লাল মিয়ার পূত্র তোতা মিয়া। লাল মিয়ার মৃত্যুর সময় ৯ লক্ষ টাকাসহ নাবালক তোতা মিয়াকে তুলে দেন ভাই দুলু মিয়ার হাতে।শর্ত থাকে যে, তোতা মিয়া সাবালক হলে ৯ লক্ষ টাকাসহ জমিদারী ফেরৎ দেওয়া হবে তাকে। সুন্দরী গুনাই বিবির সাথে স্কুলে পরিচয় ঘটে তোতা মিয়ার।পরস্পরের প্রতি দুজনে আকৃষ্ট হলেও সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে কারো পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব হয় নাই। অপর দিকে ঘরে সুন্দরী স্ত্রী ও সন্তান থাকা সত্যেও গুনাইকে বিয়ে করতে চায় তোতার লম্পট চাচা দুলু। রফিকের আদরের বোন গুনাইকে লম্পট ও ভাইয়ের ছেলের |
আশমান সিংহঃ
ঝালকাঠি জেলার আরেকটি হ্নদয় বিদারক সতাশ্রয়ী কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে আশমান সিং এর কাহিনী। এ কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে কবিতা, পুঁথি, পালাগান ও লোকনৃত্য। দক্ষিণাঞ্চলের মগ জলদস্যুদের দমন করতে সুগন্দা নদীর উত্তরে নলছিটি থানার অন্তর্গত সুজাবাদের কিল্লা স্থাপনা এ সূত্রেই গ্রামের নাম হয় সুজাবাদ। মগ জলদস্যুদের সংগে যারা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তাদেরকে মোঘল সম্রাজ্যের পক্ষ থেকে শাহ সুজা এ এলাকায় লাখেরাজ সম্পত্তি দান করেছিলেন। সে সূত্রে আশমান সিং এর পরিবার এ লাখেরাজ সম্পত্তি হিসেবে লাভ করেছিলেন সুজাবাদ গ্রামটি। একই গ্রামের লোকমান সিং এর মেয়ে রায় দূর্গা নামে এক পরমা সুন্দরীর সাথে আশমান সিং পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। আর্থিক অনটনের কারণে আশমান সিং অধিকাংশ সময় নলছিটি বন্দরে এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর কাছে থাকতেন। আশমান সিং এর এ অনুপন্থিতির সুযোগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের খোদানেওয়াজ খাঁর সংগে দূর্গার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে। খোদা নেওয়াজ খাঁর পূর্ব পুরুষরাও ছিলেন শাহ সুজার সৈন্যদলের সদস্য। শিকারের নাম করে খোদানেওয়াজ খাঁ প্রায়ই দূর্গার বাড়িতে যেতেন। কিছুদিন |
বিয়ের গানঃ
বাংলা লোক সংস্কৃতির মুল্যবান সম্পদ হয়লাগান বা বিয়ের গান। ঝালকাঠির মত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও হয়লাগান প্রচলিত ছিল। গায়ে হলুদ, কনে সাজানো, বরের আগমন ও বন্ধুবান্ধবসহ বরের বৈঠকস্থল পর্যন্ত অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এ আঞ্চলিক গানগুলো। গ্রামের অক্ষরবিহীন মহিলারা এ গানগুলো গাইতেন। পরবর্তীতে অর্ধ শিক্ষিত মহিলারাও এ সকল হয়লাগানে অংশ নিতেন। ষাটের দশকেও ঢাকার বাংলা ছায়াছবিতে বিয়ের গান সংযোজিত হয়েছিল। তবে গানগুলোর মধ্যে দু একটি গান বাদে বাকী গান ঝালকাঠি অঞ্চলের। ষাটের দশকেও বিয়ের প্রস্তুতি লগ্ল থেকে শুরু করে বর কনে বিদায় মুহুর্ত পর্যন্ত আনন্দবেদনা মিশ্রিত এ সব গান খুবই জনপ্রিয় ছিল। |
জারীগান
সমগ্র দক্ষিণ বাংলায় জারীগান অত্যন্ত জনপ্রিয়। জারীগানের পাগল এতদাঞ্চলের মানুষ। জারীগানের কথা শুনলে আবাল বৃদ্ধবনিতা ছুটে চলে জারীগানের আসরে। জারী গানের অপ্রতিদন্ধি গায়ক জারী সম্রাট আবদুল গনি বয়াতীর জন্ম ঝালকাঠি জেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের নুরুল্লাপুর গ্রামে বাংলা ১৩১৬ সনের ২ |
পুঁথি পাঠঃ
বাংলা লোক সাহিত্য সম্পদের অন্যতম পুঁথি সাহিত্য। সাধারণত মুসলমান পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরা ঘরে বসে ঘটনাবহুল সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে রচিত পুঁথি পাঠ করতেন। এ সব পুঁথির মধ্যে ছিলঃ হাতেমতাই, গাজীকালু চম্পাবতি, ইউসুফ জুলেখা, ইসমাইলের কোরবানী, সোনাবানের পুঁথি, ভাষা ও সংস্কৃতিপুরুষ এসে ভিড় করতেন। গ্রাম গঞ্জের পুঁথি পাঠের প্রবীন শিল্পীদের অনেক কদর ছিল। এ সব পুঁথিপাঠ শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন মোঃ আলম, আকবর আলী, আবদুর |
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS